এই নিবন্ধটি ইংরেজিতে পাবেন এখানে।
সংশপ্তক এর লেখা এই নিবন্ধটি এঙ্গেজমিডিয়ার ইয়ুথ অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন ফর ইন্টারনেট ফ্রিডম প্রজেক্ট এর আওতায় প্রকাশিত। এই প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তরুণদের ডিজিটাল অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা।
সংশপ্তক, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি সেচ্ছাসেবা ভিত্তিক কুইয়ার মোবিলাইজিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মানুষকে সংগঠিত করা এবং তাদের ক্ষমতায়নের জন্য নিবেদিত। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য কুইয়ার ব্যক্তি, সংগঠন, অধিকারকর্মীদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কুইয়ার মানুষদের জন্য একটি নিরাপদ ও প্রানবন্ত পরিবেশ ও সম্প্রদায় গড়ে তোলা। সংশপ্তক বাংলাদেশের কুইয়ার আন্দোলনকে বিকেন্দ্রীকরণে প্রতিশ্রুতিব্ধ, যারা তৃণমূল পর্যায়ে সুযোগ তৈরি করে, আদিবাসীদের ক্ষমতায়ন করে, নাগরিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ায়, আইনি সহায়তা প্রদান করে, মানবিক ও ডিজিটাল অধিকার ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে এবং কুইয়ার সম্প্রদায়ের মধ্যে দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধি করে।
মুখবন্ধ
২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী যখন সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা পত্রের প্লাটিনাম জয়ন্তী উদযাপিত হয়েছে তখন বাংলাদেশের কুইয়ার জনগোষ্ঠী তাদের ইন্টারনেট স্বাধীনতার মতো ন্যূনতম মানবাধিকার গুলোকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশের ১২ তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে লক্ষ্য করে বিগত বছর গুলোতে যে কয়টি কঠোর ও অকল্যাণকর আইন প্রণীত হয়েছে, সাইবার সিকিউরিটি আইন ২০২৩ (সিএসএ) তাদের মধ্যে অন্যতম। যা বাংলাদেশের কুইয়ার আন্দোলন ও এর জনগোষ্ঠীকে সেল্ফ-সেন্সরশীপের মতো অন্ধকারে ঠেলে দিতে বাধ্য করছে। গত ১৩ই নভেম্বর ছিলো জাতিসংঘে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত চতুর্থ ইউপিআর রিভিউ-এর দিন। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে ২০২২ সাল থেকেই বাংলাদেশের কুইয়ার অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠন এবং নাগরিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ইউপিআর-এর ছায়া প্রতিবেদন তৈরির জন্য কাজ করছিলো। কিন্তু রিপোর্টটি তৈরি হবার পর যে প্রশ্নটা সামনে আসে, তা হলো কোন সংগঠনের নামে এই রিপোর্টটি সাবমিট করা হবে? কারণ জাতিসংঘে ইউপিআর- এ শ্যাডো রিপোর্ট জমা দিতে গেলে সংগঠনের নাম প্রকাশ করতেই হয়। কিন্তু একদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনী জটিলতার কারণে কুইয়ার সংগঠনগুলোর জন্য তাদের পরিচয় প্রকাশই একটি হুমকি, অন্য দিকে সিএসএ-এর ২৫(খ) ধারার ভয়, সবকিছুকে মাথায় নিয়ে বাধ্য হয়ে আমরা একটি বিলুপ্ত সংগঠনের নাম ব্যবহার করে উক্ত ছায়া প্রতিবেদনটি জমা দেই।
স্বতঃপ্রনোদিত বিধিনিষেধের ছায়ায়
এই লেখাটি লেখার সময় আমি একটি সংগঠনের নামকে ব্যবহার করছি। একজন কুইয়ার অর্গানাইজার হিসেবে আমার অধিকাংশ লেখাই বেনামে লেখা, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ভয়ে আমাদের সকল কার্যক্রমে আমরা নিয়মিত মুছে ফেলতে বাধ্য হচ্ছি। এই একই আইনের ফলে আমাদের দেশীয় কুইয়ার সংগঠনগুলো তাদের নিজেদের ওয়েবসাইট তৈরি করা নিয়ে ভয়ের মধ্যে থাকে, যদি কেউ ওয়েবসাইট তৈরি করেও থাকে তবে সেখানেও খুব সীমিত তথ্য প্রদান করা হয়। কারণ সিএসএ-এর ৮ ধারা ব্যবহার করে সরকার চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো ওয়েবসাইটকে বন্ধ করে দিতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র দুইটি কুইয়ার সংগঠন তাদের বিশেষায়িত ওয়েবসাইট তৈরি করতে পেরেছে যেখানে সকল তথ্য পাবার জন্য ইউজার আইডি আর পাসওয়ার্ড দিয়ে বিশ্বস্ত মানুষেরা প্রবেশ করে, তাদের সম্পর্কে তথ্য পেতে পারে। এই বাস্তবতায় সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিস্তৃতি কেবল যে অপরাধ ও শাস্তিতে সীমাবদ্ধ তাই নয়, এই আইন বাংলাদেশের কুইয়ার সম্প্রদায়কে প্রতিদিন সেলফ সেন্সরশিপের জন্য বাধ্য করছে।
বিগত ১২ বছরের কমিউনিটি ভিত্তিক অর্গানাইজিং করতে গিয়ে দেখেছি বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় কুইয়ার কমিউনিটির আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে গেলে ইন্টারনেট এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। এবং এই ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতা বর্তমান বিশ্বে অন্যতম একটি মানবাধিকার বলে গণ্য করা হয়, যা ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কাউন্সিলে রেজুলেশন গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমগুলোকে সিএসএ-এর মতো কঠোর আইন দিয়ে শুধু বন্ধই করে দেয়া হচ্ছে না, এই আইনের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের ডিজিটাল মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে ও ইন্টারনেট সেন্সরশীপ আরোপ করা হচ্ছে নিয়মিত, যা বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক। এর পাশাপাশি সরকারের পক্ষ হতে দেশব্যাপী ইন্টারনেট শাটডাউনের মতো ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।
বিষয়টি এমন নয় যে আমরা চাইলেই গোপনে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারি। বর্তমানে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ন্যায় একটি অস্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে অনেক গুলো উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার ইন্ট্রিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইএলআইএইস) ইতোমধ্যেই চালু করেছে। এই প্রযুক্তিটি বাস্তবায়নের ফলে সরকারী আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে তার সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবে যা, বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ এর (খ) অনুচ্ছেদের সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। এবং শুধু এই আইএলআইএস প্রযুক্তিকে আলাদা করে না দেখে এর সাথে আমাদের দেখতে হবে সিএসএ, ধারা ৪২ কে যেখানে কেবল মাত্র সন্দেহে কারণেই আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিনা পরওয়ানায় একজন ব্যক্তির অনলাইন ও অফলাইনে সকল হার্ডওয়্যার, সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট ও দলিল দস্তাবেজ তল্লাশি এবং গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, এই ধারাটিও সংবিধানের ৪৩(খ) অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক। এমন আইন ও ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশের কুইয়ার জনগোষ্ঠীর সদস্য ও সংশপ্তকের মতো যে সকল সংগঠন কুইয়ার কমিউনিটির অধিকার সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছেন তাদের গ্রেফতার আতঙ্ক, পুলিশি হয়রানী ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের কুইয়ার জনগোষ্ঠীর উপর সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে ধারা সমূহ আতংক তৈরি করছে
২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫০ বর্ষপূর্তিতে একজন হিজড়া মুক্তিযোদ্ধার গল্প প্রকাশ পায়। এই গল্পটি দেখে/পড়ে কেউ যদি দাবি করেন এই দেশ কেবল মাত্র সিস-নারী-পুরুষদের জন্য নয়। কিংবা যদি বলেন মুক্তিযুদ্ধ কেবলমাত্র নারী-পুরুষেরা করেননি, কুইয়ার মানুষেরাও করেছে, জাতির পিতা সকলেরই মুক্তি চেয়েছে। অথবা যদি কোনো কুইয়ার মানুষ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সাথে রংধনু পতাকা জুড়ে দেয় তাহলে এমন কর্মকান্ড এই আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী একটি শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।
সিএসএ-এর ২৫ ধারা সম্পূর্ণ কুইয়ার জনগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত এ্যাডভোকেসী ও আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। কারণ আমরা যদি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের কুইয়ার মানুষের সাথে চলা অন্যায় ও অবিচার সম্পর্কে কোনো রিপোর্ট প্রেরণ বা প্রকাশ করি কিংবা অন্য কেউ যদি আমাদের প্রেরিত রিপোর্ট প্রকাশ করে, অথবা কুইয়ার কোনো মানুষ যদি তার সাথে ঘটনা কোনো অন্যায়- অত্যাচার সম্পর্কে অনলাইনে কোনো কনটেন্ট প্রকাশ করে, তাহলে যার/যাদের সম্পর্কে ওই কনটেন্ট বা রিপোর্টে কথা বলা হয়েছে তারা, এমনকি রাষ্ট্রও চাইলে আমাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের সাথে ঘটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার, সেই অধিকারকে সীমিত করা হচ্ছে এই ধারার মাধ্যমে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০২২ সালে বাংলাদেশের সর্বশেষ জনশুমারী করা হয়। সেই জনশুমারীতে জেন্ডারের জায়গায় নারী পুরুষের পাশাপাশি হিজড়াকে-ও একটি জেন্ডার ক্যাটাগরিতে রাখা হয়। শুমারি শেষে দেখা যায় সরকারের ভাষ্যমতে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা মাত্র ১২৬২৯ জন! এই সংখ্যাটি কুইয়ার কমিউনিটির পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করে বলা হয় এই সংখ্যা প্রায় দেড় লাখেরও বেশি। আমরা প্রত্যাখ্যান করলেও এটি একটি সরকার স্বীকৃত ডাটা। এখন কোনো কুইয়ার মানুষ যদি এই শুমারি প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে তবে সহজেই তার বিরূদ্ধে এই ধারার আওতায় বিচারিক প্রক্রিয়া ও তাকে শাস্তির মুখে দাঁড় করানো সম্ভব, যদি সরকার তা চায়। অর্থাৎ এই আইনের কারণে আমাদের মানবাধিকার সরকারের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের অসম্মানজনক বক্তব্যের প্রতিবাদে সংশপ্তক একটি স্টেটমেন্ট প্রকাশ করে, সরকার চাইলে এই স্টেটমেন্ট প্রকাশ করাকে যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষতির কারণ হিসেবে আখ্যা দিয়ে সংশপ্তকের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে এই আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী। এই ধারাতেও এমন কতগুলো শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে যার কোনো সুনির্ধারিত ব্যাখ্যা নেই, যেমন: “রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা”, “জনগণ বা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয়ভীতি সঞ্চার করা”। কুইয়ার সংগঠন ও ব্যক্তিরা তাদের অধিকার বিষয়ে অনলাইনে মাধ্যমে কোনো প্রচারণা, ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে গেলে একে সহজেই এই ধারার আওতায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে চিহ্নিত করা এবং মামলা রুজু করা সম্ভব।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের অনুভূতির সাথে সমকামিতা বা লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যতা একটি সাংঘর্ষিক ধারণা সেটা বলাই বাহুল্য। এই বাস্তবতায় সংশপ্তক যদি কুইয়ার মানুষদের অধিকার নিয়ে কথা বলে স্বভাবতই তা আব্রাহামিক ধর্ম অনুসরণকারী গোষ্ঠীদের ধর্মীয় অনুভূতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে। এবং বাংলাদেশের কুইয়ার মানুষেরা সবচাইতে বেশি হুমকির মুখে থাকে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা। আমরা নিশ্চয়ই ২০১৬ সালের বাংলাদেশের দুইজন সমকামী অধিকার কর্মীর নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা ভুলে যাইনি। ওই উগ্রবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহ দেয়া হয়েছে সিএসএ-এর ২৮ ধারার মতো ডি-ফ্যাক্টো একটি ব্লাসফেমি আইনের দ্বারা। যেখানে সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে, সেখানে এমন একটি ব্লাসফেমাস আইন দিয়ে সরকার একটি বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর অবস্থানকে শুধু অস্বীকারই করেনি বরং আইনীভাবে নিষিদ্ধও করেছে। একদিকে ২৮ ধারা দিয়ে যেমন কুইয়ার মানুষদের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অন্য দিকে এই আইনের ২৯ ধারার কারণে কুইয়ার কমিউনিটি অনলাইনে তাদের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে এবং চাইলেও আমাদের বিরুদ্ধে উগ্রবাদীদের চলা হেইট ক্রাইম, অপপ্রচার ও কমিউনিটির উপর আরোপিত মিথ্যা তথ্য গুলোর বিরুদ্ধে কোনো শক্ত অবস্থান নিতে পারছি না। ইতোমধ্যেই এই একটি ধারা মুক্তমত চর্চার উপর রাষ্ট্র ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের উন্মুক্ত হস্তক্ষেপ ও সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদের চরম লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পেয়েছি।
যে কোনো বৈষম্যের শিকার গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের জন্য ক্রস বর্ডার এক্টিভিজম ও প্রবাসী জনগোষ্ঠীর সাপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারা ৪ বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী কুইয়ার মানুষদের জন্যও হুমকি তৈরি করছে। এবং এমন আইনের কারণে বর্তমানে আমাদের ক্রস বর্ডার এক্টিভিজম ও প্রবাসী জনগোষ্ঠীর সাপোর্টও প্রায় বন্ধের পথে।
বাংলাদেশের হিজড়া, আদিবাসী এবং প্রান্তিক কুইয়ার জনগোষ্ঠীকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় গুণতে হবে বাড়তি মাশুল
বাংলাদেশের কুইয়ার জনগোষ্ঠী সামাজিক ও আইনগত ঝুঁকির কারণে সাধারণত ফেইক আইডি ব্যাবহার করে অনলাইনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে থাকে। এই ক্ষেত্রে আইনের বিষয়ে বিশেষ সচেতনতা নেই এমন তৃনমূল পর্যায়ের কুইয়ার মানুষ, হিজড়া, আদিবাসী কুইয়ার মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রেই কোনো আইকনিক চরিত্রের ছবি ও নাম সম্বলিত সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট পরিচালনা করেন। আবার হিজড়া, ট্রান্সম্যান, ট্রান্সওম্যানরা তাদের আকাঙ্ক্ষিত পরিচয় ধারণ করার লক্ষ্যে তাদের বায়োলজিক্যাল সেক্সের জন্য নির্ধারিত পোশাক বাদ দিয়ে তাদের জেন্ডারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পোশাক পরিধান ও সাজগোজ করে থাকেন, যাকে আমাদের সিস-নরমেটিভ সোসাইটিতে ক্রস-ড্রেসিং বলে সম্বোধন করা হয়। উল্লেখিত এই তিনটি বিষয়ই কুইয়ার কমিউনিটির মানুষের অনলাইনে নিজের সত্ত্বা প্রকাশের অন্যতম প্রধান-মাধ্যম যাকে সিএসএ’র ধারা ২৪ দিয়ে ক্রিমিনালাইজ করা হয়েছে। এবং এই ধারাটি, ১৯৪৯ সালে বিলুপ্ত হওয়া কলোনিয়াল আইন ক্রিমিনাল ট্রাইবস আইন ১৮৭১, এর ২৬ ধারারই একটি প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠী বেশিরভাগ সদস্যই প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পর্যন্ত পার করতে পারেনি। আবার আদিবাসী কুইয়ার মানুষেরা তাদের মৌলিক চাহিদার জন্য যুদ্ধ করছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষা সহ অন্যান্য নাগরিক সেবা হতে পাহাড়ে ও সমতলের আদিবাসীরা বঞ্চিত, এবং নিম্নবিত্ত কুইয়ার মানুষেরাও একই অবস্থায় আছেন। সোশ্যাল মিডিয়া তারা ব্যবহার করেন ঠিকই কিন্তু যে ডিজিটাল লিটারেসি তাদের থাকা প্রয়োজন তার কিছুই তাদের কাছে নেই। এই বাস্তবতায় কোনো অপরাধী সহজেই তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সিএসএ-এর ধারা ১৭ হতে শুরু করে ৩৭ পর্যন্ত ধারায় বর্ণিত অপরাধসমূহ সংঘটিত করতে, এমনকি হ্যাকিং এর মতো অপরাধ ও যেকেউ তাদের ডিভাইস ব্যবহার করে করতে পারে। যদি সত্যি অন্য কেউ এই কুইয়ার মানুষগুলোর ডিভাইস ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত করে থাকে, তবে তার জন্য এই আইনের ৩৩ ধারা অনুয়ায়ী শাস্তি পেতে হবে নিরপরাধ মানুষগুলোকে। কিংবা অপরাধ প্রমানিত হবার পূর্ব সময় পর্যন্ত তাদের আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আর বাংলাদেশের আইনী কাঠামো ও বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলাই বাহুল্য।
সংশপ্তকের আহ্বান
২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের সকল কুইয়ার অধিকার ভিত্তিক সংগঠনের একটি অভিন্ন দাবী সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো এমন অগণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে উৎসাহ প্রদানকারী সকল আইন আপদমস্তক বাতিল করতে হবে। এছাড়াও দেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ভিত্তিক সংঠনগুলোর প্রতি আমাদের উদাত্ত আহ্বান, আপনারা বাংলাদেশের কুইয়ার সম্প্রদায়ের উপর চলা নির্যাতনের চিত্রগুলো প্রকাশ করুন ও সরকারকে আমাদের উপর চলা নির্যাতন বন্ধের জন্য আহ্বান জানান। বাংলাদেশের কঠোর আইন ও আইনগত নিষেধাজ্ঞার ফলে কুইয়ার সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন গুলো সরকারী নিবন্ধন পাচ্ছে না, যার ফলে সংশপ্তকের মত সংগঠনগুলো অর্থাভাবে আমাদের সংগঠিত করার কার্যক্রমগুলোও পরিচালনা করতে পারছি না। এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাই, বাংলাদেশের কুইয়ার অধিকার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে সরকারি নিবন্ধনের বেড়াজাল হতে মুক্ত হয়ে কাজ করতে আপনাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। বাংলাদেশের কুইয়ার মানুষদের উপর সরকার, আইন, উগ্রবাদী গোষ্ঠীদের সৃষ্ট একটি ঝড় চলছে, আমরা স্বপ্ন দেখি এই ঝড় একদিন শেষ হবে। ঝড় শেষে মুক্ত আকাশে ভেসে উঠবে রংধনু। আমাদের সেই স্বপ্নপূরণের সারথী হতে সকলের প্রতি বিনিত আহ্বান জানায় সংশপ্তক।
নোট: এই লেখাটির মধ্যে কুইয়ার শব্দটি দিয়ে বোঝানো হচ্ছে লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সম্যান, ট্রান্সওমেন, ইন্টারসেক্স, হিজড়া, কতি, নন-বাইনারি, জেন্ডার ফ্লুইড, কোশ্চেনিং, কিউরিয়াস, এসেক্সুয়াল, প্যানসেক্সুয়াল, জেন্ডার নন-কনফার্মিং, এন্ড্রোজেনাস, জেন্ডারকুইয়্যার, এজেন্ডার, ইন্টারজেন্ডার সহ আরো যে সকল লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী রয়েছেন তাদের সকলকে।
Comments are closed.